আওয়ামী লীগের কব্জা থেকে বিএনপিতে গেল চট্টগ্রামের তুলা ও স্ক্র্যাপ ব্যবসার দখল
ভাগাভাগির বৈঠকে মারও খেলেন বিএনপি নেতা
চট্টগ্রামে টেক্সটাইল মিল থেকে তুলা ও স্ক্র্যাপ বের করার ব্যবসা আগে ছিল আওয়ামী লীগ নেতা দিদারুল আলম, এসএম আল মামুন, এহসানুল হায়দার চৌধুরী বাবুল ও নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জুর হাতে। এখন সেটা চলে এসেছে বিএনপি নেতা মঞ্জুর আলম মঞ্জু, আলাউদ্দীন ও নুরুল আকবর কাজলের দখলে।
চট্টগ্রামে টেক্সটাইল কারখানা থেকে তুলা ও স্ক্র্যাপ বের করা নিয়ে মুখোমুখি হয়েছে বিএনপির দুই গ্রুপ। এর জের ধরে মারধরের শিকার হয়েছেন এক বিএনপি নেতাও। আগে এসব কাজ আওয়ামী লীগ নেতাদের কয়েকটি গ্রুপ করলেও এখন পুরোটাই গেছে বিএনপি নেতারা দখলে। তবে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ওই সময় বিএনপি নেতাদেরও যোগসাজশ ছিল। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিএনপি নেতারা এবার আর ভাগাভাগিতে যাননি।
জানা গেছে, বর্তমানে নগর বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মঞ্জুর আলম মঞ্জু, কাট্টলী বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আলাউদ্দীন ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা নুরুল আকবর কাজল মিলে তুলা ও স্ক্র্যাপ বের করার কাজ করছেন।
এর আগে সীতাকুণ্ডের সাবেক সাংসদ দিদারুল আলম ও এসএম আল মামুন, রাউজানের উপজেলা চেয়ারম্যান এহসানুল হায়দার চৌধুরী বাবুল, সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর রুবি বেগম ও ১০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু এসব তুলা ও স্ক্র্যাপ বের করতেন। তবে ওই সময় বিএনপির ওই তিন নেতারও ব্যবসা ছিল টেক্সটাইলে মিলে।
স্থানীয় বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছ থেকে কমিশন নিয়ে এসব তুলা ও স্ক্র্যাপ বের করছেন নগর বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মঞ্জুর আলম মঞ্জু, কাট্টলী বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আলাউদ্দীন এবং ৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা নুরুল আকবর কাজল। একই সঙ্গে সাগরিকা শিল্প এলাকায় ফোর এইচ গ্রুপসহ একাধিক কারখানার ঝুটসহ নানা পণ্যের দখলও গেছে তাদের হাতে।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ আমলে রোহান এন্টারপ্রাইজের নামে কাউন্সিলর রুবি বেগম, ইকবাল হেসেন এন্টারপ্রাইজের নামে সাবেক এমপি দিদারুল ও কাজী আলতাফ, প্রত্যাশার নামে মাসুম কুতুব, আছিয়া এন্টারপ্রাইজের নামে সাবেক কাউন্সিলর আরজু সাহাব উদ্দীন, চিটাগাং ট্রেডিংয়ের নামে রাউজানের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বাবুল, ফ্রিডম ফাইটারের নামে আকতার উদ্দীন ও নুরুদ্দীন, প্রাইম এন্টারপ্রাইজের নামে মনজুর আলম মঞ্জু, আলাউদ্দীন ও কাজল এবং বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজের নামে আওয়ামী লীগ নেতা ইকবাল ও আবুল কালাম আবু তুলা ও স্ক্র্যাপ বের করতেন।
ওই সময় ইস্পাহানি গ্রুপের পাহাড়তলী টেক্সটাইল থেকে তুলা ও স্ক্র্যাপ নিতেন আওয়ামী লীগ নেতারা। প্রতি এক থেকে দেড় মাস পর পর ১০০ টন তুলা ও স্ক্র্যাপ মাল বের করা হতো ফ্যাক্টরি থেকে। তবে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগপন্থী কেউ আর মালামাল নিতে আসেনি।
গত শুক্রবার (১৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে আওয়ামী নেতাদের সঙ্গে ‘সমঝোতা’ করে তিনটি ট্রাকে করে তুলা ও স্ক্র্যাপ নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন বিএনপির মঞ্জু-আলাউদ্দীন গ্রুপ। তবে সন্ধ্যায় এসব ট্রাক ফ্যাক্টরি থেকে বের হতেই সেগুলো আটকে দেন স্থানীয় বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা।
পরে এ ঘটনার সমঝোতা করতে উত্তর পাহাড়তলী বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমানের সিডিএ মার্কেটের অফিসে বৈঠক হয়। বৈঠকে উপস্থিত একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, আওয়ামী লীগের নেতাদের পক্ষ হয়ে কেন এসব ‘মাল’ বের করছেন-জানতে চাইলে আলউদ্দিন স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের গালিগালাজ করেন। ওইস ময় বিএনপির সাবেক নেতা মঞ্জুকে আলাউদ্দিন ফোন করার পর তিনিও উপস্থিত বিএনপি নেতাদের হুমকি দেন। এরপর আলাউদ্দিনের ওপর চড়াও হন স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা। এর একপর্যায়ে তারা আলাউদ্দিনকে মারধর করেন বলে জানা গেছে।
এ নিয়ে উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ড যুবদলের আহ্বায়ক মো. ইউনুচসহ বৈঠকে এ ঘটনার বিষয়ে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে সমঝোতা হয়। তবে মার খেয়ে আলাউদ্দিন আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে ব্যবসা করবেন না বলে ক্ষমা চান। ওদিকে এ ঘটনা জানাজানি হলে মঞ্জু ও কাজল পালিয়ে যান বলে জানা গেছে।
যদিও এসব অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে কাট্টলী বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আলাউদ্দিন বলেন, ‘আটকে দেওয়া তিন ট্রাক মালের মধ্যে এক গাড়ি মাল আমার। বাকি দুই ট্রাক কার মাল ছিল তা আমার জানা নেই। আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’
সমঝোতা বৈঠকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে উপস্থিত আকবরশাহ থানা বিএনপির আহ্বায়ক গিয়াসউদ্দিন টুনু বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতাদের মাল বের করতে গিয়ে মারধরের শিকার হন আলাউদ্দিন। তবে এ ঘটনার বিচার করে দেওয়ায় আমাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে থানায় গেছেন তিনি।’
উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ড যুবদলের আহ্বায়ক মো. ইউনুচ বলেন, ‘তিন গাড়ি মাল বের করার আগে আরও ১০ গাড়ি মাল বের করেছে মঞ্জু, আলাউদ্দিন ও কাজল। প্রতি গাড়ি মালের ওপর ১০ শতাংশ করে কমিশন নিয়ে এ কাজ করছিল তারা। স্থানীয় বিএনপির নেতারা এসব গাড়ি আটকে দেয়। এরপর গণধোলাই দেয় আলাউদ্দিনকে।’
এদিকে কাট্টলী বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আলাউদ্দীন বলেন, ‘২০০২ সাল থেকে এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসা করছি। কর্তৃপক্ষ পছন্দ করে বলেই আওয়ামী লীগ সরকার আমলেও ব্যবসা করতে পেরেছি। তারা সেদিন গাড়ি আটকের পর আমাকে মারধর করেছে। পরে গাড়ি ছাড়াই আমি ফিরেছি। জানতে পেরেছি, অন্য দুটি গাড়ি থেকে ১০ হাজার টাকা চাঁদা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।’
নগর বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মঞ্জুর আলম মঞ্জু বলেন, ‘আমার সঙ্গে কারও কোনো সমস্যা হয়নি। কারা গাড়ি আটকে চাঁদা দাবি করছে, কারা মারধর করেছে-সবই ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে জানতে পারবেন। যাদের সঙ্গে এ সকল ঘটনা ঘটেছে, তারা এ বিষয়ে মামলা করেছে।’
এর আগে সাগরিকা শিল্প এলাকার ফোর এইচ গ্রুপের ব্যবসায়ী নুরুল আলম নুরুর কাছ থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় মঞ্জুর আলম মঞ্জু, আকবর শাহ থানার বিএনপি সাধারণ সম্পাদক মাইনুদ্দীন হাসান মাইনু, কাট্টলী বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফরিদুল আলম ফরিদ ও সাংগঠনিক সম্পাদক আলাউদ্দীন যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ তোলেন নুরু।